অব্যয় পদ

অব্যয় পদ
ন ব্যয় = অব্যয়। যার ব্যয় বা পরিবর্তন হয় না অর্থাৎ যা অপরিবর্তনীয় শব্দ তাই অব্যয়। যে পদ সর্বদা অপরিবর্তনীয় থেকে কখনো বাক্যের শোভা বর্ধন করে, কখনো একাধিক পদের, বাক্যাংশের বা বাক্যের সংযোগ বা বিয়োগ সম্বন্ধ ঘটায়, তাকে অব্যয় পদ বলে।

অব্যয় পদের বৈশিষ্টসমূহঃ
ক) অব্যয় শব্দের সাথে কোনো বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয় না।
খ) অব্যয় শব্দের একবচন বা বহুবচন হয় না।
গ) অব্যয় শব্দের স্ত্রী বা পুরুষবাচকতা নির্ণয় করা যায় না।

বাংলা ভাষায় তিন প্রকার অব্যয় শব্দ রয়েছে। যথাঃ
১) বাংলা অব্যয় শব্দঃ আর, আবার, ও, হ্যাঁ, না ইত্যাদি।

২) তৎসম অব্যয় শব্দঃ যদি, যঘা, সদা, সহসা, হঠাৎ, অর্থাৎ, দৈবাৎ, বরং, পুনশ্চ, আপাতত, বস্তুত ইত্যাদি।

৩) বিদেশি অব্যয় শব্দঃ আলবত, বহুত, খুব, খূসা, মাইরি, শাবাশ, মারহাবা ইত্যাদি।

বিবিধ উপায়ে গঠিত অব্যয় শব্দঃ
ক) একাধিক অব্যয় শব্দযোগেঃ কদাপি, নতুবা, অতএব, অথবা
খ) আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশক একই শব্দের দুবার প্রয়োগঃ ছি ছি, ধিক ধিল, বেশ বেশ ইত্যাদি।

গ) দুটো ভিন্ন শব্দ যোগেঃ মোট কথা, হয়তো, যেহেতু, নইলে।

ঘ) অনুকার শব্দযোগেঃ কুহু কুহু, গুন গুন, ঘেউ ঘেউ, শন শন, ছল ছল, কন কন ইত্যাদি।

অব্যয়ের প্রকারভেদ
অব্যয় প্রধানত চার প্রকার।।যথাঃ
১) সমুচ্চয়ী অব্যয়
২) অনন্বয়ী অব্যয়
৩) অনুসর্গ অব্যয়
৪) অনুকার/ধ্বন্যাত্মক অব্যয়

১) সমুচ্চয়ী অব্যয়
যে অব্যয় পদ একটি বাক্যের সঙ্গে অন্য একটি বাক্যের অথবা বাক্যস্থিত একটি পদের সঙ্গে অন্য একটি পদের সংযোজন, বিয়োজন বা সংকোচন ঘটায়, তাকে সমুচ্চয়ী অব্যয় বা সম্বন্ধবাচক অব্যয় বলে।
সমুচ্চয়ী অব্যয় আবার তিন প্রকার। যথাঃ
ক) সংযোজক অব্যয়
খ) বিয়োজক অব্যয়
গ) সংকোচক অব্যয়

ক) সংযোজক অব্যয়
ও, এবং, তাই, আর, অধিকন্তু, সুতরাং ইত্যাদি। যেমনঃ
⇨ উচ্চপদ সামাজিক মর্যাদা সকলেই চায়।
⇨ তিনি সৎ, তাই সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে।

খ) বিয়োজক অব্যয়
কিংবা, বা, অথবা, নতুবা, না হয়, নয়তো ইত্যাদি। যেমনঃ
⇨ হাসেম কিংবা কাসেম এর জন্য দায়ী।
⇨ মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।

গ) সংকোচক অব্যয়
কিন্তু,  অথচ, বরং ইত্যাদি। যেমনঃ
⇨ তিনি বিদ্বান, অথচ সৎ ব্যক্তি নন।

অনুগামী সমুচ্চয়ী অব্যয়
যে, যদি,  যদিও, যেন প্রভৃতি কয়েকটি শব্দ সংযোজক অব্যয়ের কাজ করে থাকে। তাই তাদের অনুগামী সমুচ্চয়ী অব্যয় বলে। যেমনঃ
⇨ এভাবে চেষ্টা করবে যেন কৃতকার্য হতে পারে।
⇨ তিনি এত পরিশ্রম করেন যে তার স্বাস্থ্যভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
⇨ আজ যদি পারি, একবার সেখানে যাব।

২) অনন্বয়ী অব্যয়
যে সকল অব্যয় বাক্যের অন্য পদের সঙৃগে কোনো সম্বন্ধ না,রেখে স্বাধীনভাবে নানাবিধ ভাব প্রকাশে ব্যবহৃত হয়, তাদের অনন্বয়ী অব্যয় বলে। যেমনঃ
হ্যাঁ, আমি যাবো। (স্বীকৃতি বা অনুমতি জ্ঞাপন)
না, আমি যাব না। (স্বীকৃতি বা অনুমতি জ্ঞাপন
⇨ আপনি যখন বলছেন, বেশ তো আমি যাব। (অনুমোদন বাচকতা)
⇨ আপনি যা জানেন তা তো ঠিকই বটে। (সমর্থন সূচক জবাব)
উঃ! পায়ে বড্ড লেগেছে। (যন্ত্রণা প্রকাশ)
নাঃ! এ কষ্ট অসহ্য। (যন্ত্রণা প্রকাশ)
ছি ছি, তুমি এত নীচ। (ঘৃণা বা বিরক্তি প্রকাশ)
কী আপদ! লেকটা যে পিছু ছাড়ে না। (ঘৃণা বা বিরক্তি প্রকাশ)
মরি মরি! কি সুন্দর প্রভাতের রূপ। (উচ্ছ্বাস প্রকাশ)
⇨ আজ আমি আলবৎ যাব। (সম্মতি প্রকাশ)
নিশ্চয়ই পারব। (সম্মতি প্রকাশ)
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। (সম্বোধন)
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে/ পাছে লোকে কিছু বলে। (সম্ভাবনা)
শুধু শুধু তিনি রেগে ওঠেন। (অভ্যাস)
⇨ কে জানে দেশে সুদিন আবার আসবে কিনা। (অনিশ্চয়তা)
মরি বাংলা ভাষা। (আনন্দ প্রকাশ)

বাক্যালঙ্কার অব্যয়
কয়েকটি অব্যয় শব্দ নিরর্থকভাবে ব্যবহৃত হয়ে বাক্যের শোভাবর্ধন করে, এদের বাক্যালঙ্কার অব্যয় বলে। যেমনঃ
⇨ হায়রে ভাগ্য, হায়রে লজ্জা, কোথায় সভা, কোথায় সজ্জা।
⇨ কত না হারানো স্মৃতি জাগে আজও মনে।

৩) অনুসর্গ অব্যয়
যে সকল অব্যয় শব্দ বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের পরে বিভক্তির ন্যায় বসে কারলবাচকতা প্রকাশ করে, তাদের অনুসর্গ অব্যয় বা পদান্বয়ী অব্যয় বলে। দ্বারা, দিয়া,হইতে, থেকে ইত্যাদি অনুসর্গ অব্যয়। যেমনঃ
⇨ ওকে দিয়ে এ কাজ হবে না।

৪) অনুকার/ধ্বন্যাত্মক অব্যয়
যে সকল অব্যয় রব, শব্দ বা ধ্বনির অনুকরণে গঠিত হয়, তাকে অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বলে। এ জাতীয় ধ্বন্যাত্মক শব্দের দুবার প্রয়োগের নাম ধ্বন্যামক দ্বিরুক্তি। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি দ্বারা বহুত্ব বা আধিক্য ইত্যাদি বোঝায়। যেমনঃ
মেঘের গর্জন ⇨ গুড় গুড়
স্রোতের ধ্বনি ⇨ কল কল
বজ্রের ধ্বনি ⇨ কড় কড়
সিংহের গর্জন ⇨ গর গর
কাকের ডাক ⇨ কা কা
চুড়ির শব্দ ⇨ টুং টাং
বাতাসের গতি ⇨ শন শন
কোকিলের রব ⇨ কুহু কুহু
বৃষ্টির তুমুল শব্দ ⇨ ঝম ঝম
ঘোড়ার ডাক ⇨ চিঁহি চিঁহি
শুষ্ক পাতার শব্দ ⇨ মর মর
নূপুরের আওয়াজ ⇨ রুম ঝুম
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান।

* অনুভূতিমূলক অব্যয়ও অনুকার অব্যয়ের শ্রেণিভুক্ত। যেমনঃ ঝাঁ ঝাঁ, খাঁ খাঁ, কচ কচ, কট কট, টল মল, ঝল মল, চক চক, ছম ছম, টন টন ইত্যাদি।

অব্যয় বিশেষণ
কতগুলো অব্যয় বাক্যে ব্যবহৃত হলে নাম-বিশেষণ, ক্রিয়া বিশেষণ এবং বিশেষণীয় বিশেষণের অর্থবাচকতা প্রকাশ করে থাকে। এদের অব্যয় বিশেষণ বলে। যেমনঃ
নাম-বিশেষণঃ অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।
ভাব-বিশেষণঃ আবার যেতে হবে।
ক্রিয়া-বিশেষণঃ অন্যত্র চলে যায়

নিত্য সম্বন্ধীয় অব্যয়
কতগুলো যুগ্মশব্দ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, সেগুলো নিত্য সম্বন্ধীয় অব্যয় রূপে পরিচিত। যেমনঃ যথা-তথা, যত-তত, যখন-তখন, যেমন-তেমন, যেরূপ-সেরূপ ইত্যাদি।
⇨ যত গর্জে তত বর্ষে না।
⇨ যথা ধর্ম তথা জয়।

যোজক
পদ, বর্গ বা বাক্যকে যেসব শব্দ যুক্ত করে সেগুলোকে যেজক বলে। যেমনঃ এবং, ও, আর, অথবা, তবু, সুতরাং, কারণ, তবে ইত্যাদি।

বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যোজক সাধারণত ৫ ভাগে বিভক্ত। যথাঃ
১) সাধারণ যোজক
২) বিকল্প যোজক
৩) বিরোধ যোজক
৪) কারণ যোজক
৫) সাপেক্ষ যোজক

১) সাধারণ যোজক
এ ধরনের যোজক দুটি শব্দ বা বাক্যকে যোগ করে। যেমনঃ
⇨ রহিম করিম এ কাজটি করেছে।
⇨ জলদি দোকানে যাও এবং পাউরুটি কিনে আনো।

২) বিকল্প যোজক
এ ধরনের যোজক একাধিক শব্দ বা বাক্যের মধ্যে বিকল্প নির্দেশ করে। যেমনঃ
⇨ লাল বা নীল কলমটা আনো।
⇨ চা না-হয় কফি খান।

৩) বিরোধ যোজক
এ ধরণের যোজক বাক্যের দুটি অংশের সংযোগ ঘটায় এবং প্রথম বাক্যের বক্তব্যের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে। যেমনঃ
⇨ এত পড়লাম কিন্তু পরীক্ষায় ভালো করতে পারলাম না।
⇨ তাকে আসতে বললাম, তবু এল না।

৪) কারণ যোজক
এ ধরনের যোজক বাক্যের দুটি অংশের মধ্যে সংযোগ ঘটায় যার একটি অন্যটির কারণ। যেমনঃ
⇨ জিনিসের দাম বেড়েছে, কারণ চাহিদা বেশি।
⇨ বসার সময় নেই, তাই যেতে হচ্ছে।

৫) সাপেক্ষ যোজক
এ ধরনের যোজক  একে অন্যের পরিপূরক হয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ
⇨ যদি রোদ ওঠে, তবে রওনা দিব।
⇨ যত পড়ছি, ততই নতুন করে জানছি।

আবেগ শব্দ
মনের নানা ভাব বা আবেগকে প্রকাশ করা হয় যেসব শব্দ দিয়ে সেগুলোে আবেগ শব্দ বলে। যেমনঃ ছি ছি, আহা, বাহ্, শাবাশ, হায় হায় ইত্যাদি।

বিভিন্ন ধরনের আবেগ শব্দের প্রয়োগঃ
১) সিদ্ধান্ত আবেগ
২) প্রশংসা আবেগ
৩) বিরক্তি আবেগ
৪) আতঙ্ক আবেগ
৫) বিস্ময় আবেগ
৬) করুণা আবেগ
৭) সম্বোধন আবেগ
৮) অলংকার আবেগ

১) সিদ্ধান্ত আবেগ
এ জাতীয় শব্দের সাহায্যে অনুমোদন, সম্মতি, সমর্থন ইত্যাদি ভাব প্রকাশ করা হয়। যেমনঃ
হ্যাঁ, আমাদের জিততেই হবে।
বেশ, তবে যাওয়াই যাক।

২) প্রশংসা আবেগ
এ ধরনের শব্দ প্রশংসা বা তারিফের মনোভাব প্রকাশে ব্যবহমত হয়। যেমনঃ
শাবাশ! এমন খেলাই তো চেয়েছিলাম।
বাহ্, চমৎকার লিখেছ।

৩) বিরক্তি আবেগ
এ ধরনের শব্দ অবজ্ঞা, ঘৃণা, বিরক্তি ইত্যাদি মনোভাব প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ
ছি ছি! এরকম কথা তার মুখে মানায় না।
জ্বালা! তোমাকে নিয়ে আর পারি না।

৪) আতঙ্ক আবেগ
এ ধরনের আবেগ শব্দ আতঙ্ক, যন্ত্রণা, কাতরতা ইত্যাদি প্রকাশ করে।  যেমনঃ
উহ্, কী বিপদে পড়া গেল।
বাপরে বাপ! কী ভয়ঙ্কর ছিল রাক্ষসটা।

৫) বিস্ময় আবেগ
এ ধরনের শব্দ বিস্মিত বা আশ্চর্য হওয়ার ভাব প্রকাশ করে। যেমনঃ
আরে! তুনি আবার কখন এলে?
আহ্! কী চমৎকার দৃশ্য!

৬) করুণা আবেগ
এ ধরনের শব্দ করুণা, মায়া, সহানুভূতি ইত্যাদি মনোভাব প্রকাশ করে। যেমনঃ
আহা! বেচারার এত কষ্ট।
হায় হায়! ওর এখন কী হবে।

৭) সম্বোধন আবেগ
এ ধরনের শব্দ সম্বোধন বা আহ্বান করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ
হে বন্ধু, তোমাকে অভিনন্দন।
ওগো, তোরা জয়ধ্বনি কর।

৮) অলংকার আবেগ
এ ধরনের শব্দ বাক্যের অর্থের পরিবর্তন না ঘটিয়ে কোমলতা, মাধুর্যতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য এবং সংশয়, অনুরোধ, মিনতি ইত্যাদি মনোভাব প্রকাশের জন্যে অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ
দুর! এ কথা কি বলতে আছে?
যাকগে, ওসব কথা থাক।

একই অব্যয় শব্দের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহারঃ
⇨ ও দিকে আর যাব না। (পুনরাবৃত্তি)
⇨ বল, আর কি চাও? (নির্দেশ)
⇨ সে দিন কি আর আসবে? (নিরাশা)
আর কি বাজবে বাঁশী? (বাক্যালঙ্কার)
⇨ করিম রহিম দুই ভাই। (সংযোগ)
⇨ আজ বৃষ্টি হতে পারে। (সম্ভাবনা)
⇨ ওকে বলা যা, না বলাও তা। (তুলনা)
⇨ খেতে যাবে? গেলে হয়। (স্বীকৃতি জ্ঞাপন)
⇨ এত চেষ্টাতে হলো না। (হতাশা জ্ঞাপন)
⇨ এখন যেও না। (নিষেধ)
⇨ তিনি যাবেন, না হয় আমি যাবো। (বিকল্প)
⇨ আর একটা মিষ্টি খাও না খোকা। (আদর/অনুরোধ)
⇨ তিনি না কি ঢাকায় যাবেন। (সম্ভাবনা)
⇨ কী করেই না দিন কাটাচ্ছে! (বিস্ময়)
⇨ ছেলে তো না, যেন একটা হিটলার। (তুলনা)
⇨ মুখ যেন পদ্মফুল। (উপমা)
⇨ খোকা যেন তোমার মঙ্গল করেন। (প্রার্থনা)
⇨ ইস্, ঠাণ্ডা যেন বরফ। (তুলনা)
⇨ লোকটা যেন আমার পরিচিত মনে হলো। (অনুমান)
⇨ সাবধানে চল, যেন পা পিছলে না পড়। (সতর্কীকরণ)
⇨ ছেলে তো নয় যেন ননীর পুতুল। (ব্যঙ্গ প্রকাশ)
⇨ তুমি কি বাড়ি যাচ্ছ? (জিজ্ঞাসা)
কী বিপদ, লোকটা যে পিছু ছাড়ে না। (বিরক্রি প্রকাশ)
কি আমীর কি ফকির, একদিন সকলকেই যেতে হবে। (সাকুল্য অর্থ)
⇨ তেমাকে নিয়ে কী মুশকিলেই না পড়লাম। (বিড়ম্বনা প্রকাশ)

Comments